জাপানি ক্লাব কাশিমা অ্যান্টলার্সের বিপক্ষে ক্লাব বিশ্বকাপ জয়ের পর রিয়াল কোচ জিদান বলছিলেন, আমার এমন খেলোয়াড়ের দরকার নেই যে প্রতি ম্যাচে ১০-২০ টা ড্রিবল করবে, আমার এমন খেলোয়াড় দরকার যে ফাইনালে হ্যাটট্রিক করে দলকে জেতাবে।
নিজের সেরা অস্ত্র রোনালদোর প্রশংসা করতে গিয়ে খোঁচাটা জিদান কাকে দিলেন সেটা স্পষ্ট নয়, তবে কথাটা বোধহয় লিওনেল মেসির হজম হয়নি।
এস্পানিওলের বিপক্ষে খেলতে নামার আগে মেসি কি মনে মনে ঠিক করেই নেমেছিলেন, নিজের সময়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বকালের সেরাদেরই একজন হয়ে যাওয়া জিদানকে ড্রিবলিং এর মায়াজালে আচ্ছন্ন করে দেবেন এই ম্যাচে?
এক মিনিটের জন্য যদি রিয়াল মাদ্রিদ কোচ এই পরিচয়টা ভুলে গিয়ে নিখাদ ফুটবলপ্রেমী হিসেবে বার্সেলোনা-এস্পানিওল ম্যাচটি দেখে থাকেন জিদান, তিনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। ফুটবলের সব মায়াজাল যে এদিন বিছিয়ে বসেছিলেন তর্কযোগ্যভাবে এ সময়ের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি! একের পর এক ড্রিবলিং, নাটমেগ, অ্যাসিস্ট, সলো রান, গোল- কি দেখাননি এদিন মেসি!
ম্যাচের প্রথমার্ধে ঠিক মেসিসুলভ খেলেননি, তারপরেও আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা আর লুইস সুয়ারেজের দারুণ রসায়নে এক গোলের লিড নিয়েই বিরতিতে গিয়েছিল বার্সা। বিরতির পর শুরু মেসি ম্যাজিক। পুরো দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেন, যতবার বল পায়ে গেছে, ন্যু ক্যাম্প দর্শকেরা মেসি মেসি রবে মুখরিত করে রাখলেন গোটা স্টেডিয়াম।
বিশেষ করে ৬৬ থেকে ৭০- এই চার মিনিটে যা করেছেন, তা অনেকদিন চোখে লেগে থাকবে ফুটবলের আনন্দ পিপাসু দর্শকেরা। ডি বক্সের একটু বাইরে ডান প্রান্তে বল পেয়েছিলেন, সামনে থাকা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে বল বাড়িয়ে তিনি তখন বক্সে ঢোকার অপেক্ষায়।
ট্যাকল করে ইনিয়েস্তাকে ফেলে দিলেন এস্পানিওল খেলোয়াড়েরা, নিজে পরে গেলেও বলটাকে জায়গা মতই ছেড়েছিলেন ‘ডন’ ইনিয়েস্তা। প্রিয় জায়গায় বল পেয়ে একে একে পাঁচ জন ডিফেন্ডারকে
কাটিয়ে শট করলেন। এস্পানিওল কিপার বলটা ফিরিয়ে দিলেও সেটা পরে লুইস সুয়ারেজের পায়ে, বল জালে গড়াতে ভুল করেননি এই উরুগুইয়ান।
তবে, এই গোলের কৃতিত্ব সুয়ারেজ নিজেও নিতে চাইবেন কিনা সন্দেহ। গোলটা যে পুরোই মেসিময়! কি-বোর্ডের বাটনের সাধ্য কোথায় এমন গোল বর্ণনা করার! ফুটবল যে শুধুই গোলের খেলা না, গোল দেয়াতেই যে সমস্ত সার্থকতা না, সেটা আরও একবার প্রমাণ করলেন মেসি।
ডিফেন্ডারদের যেভাবে কাটিয়েছেন, বলের উপর নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে সাপের মত এঁকেবেঁকে যেভাবে বক্সে ঢুকেছেন, গোলটা না দেখে থাকলে আপনাকে সেটা বোঝানো অসম্ভব। একজন তো জার্সি ধরে টানই মেরেছিলেন, তাও নিয়ন্ত্রণ হারাননি মেসি।
মেসির ড্রিবলিং কতটা মোহময় ছিল, লুইস সুয়ারেজ আর কোচ এনরিকের অভিব্যক্তিই সেটা বলে দেবে। মেসি যখন ড্রিবল করছিলেন, সুয়ারেজ স্রেফ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন! বলটা জালে ঠেলে দেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনিও উপভোগ করছিলেন বল পায়ে এই জাদুকরের জাদু। আর গোলের পর এনরিকের শিশুসুলভ হাসি আর উল্লাসই বলে দিচ্ছিল, নিজের সেরা ছাত্রের এই মায়াবী কীর্তিগুলো তাঁকে কতটা গর্বিত করে!
হাসি মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আবারো মেসির জাদুকরী মুহূর্ত। যেন অনেকটা আগের গোলেরই কার্বন কপি! নেইমারের থেকে বল পেয়ে চারজন ডিফেন্ডারের পায়ের ফাঁক গলে মুহূর্তের মধ্যে ঢুকে পরেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েই ফেলেছিলেন, পাশ থেকে দৌড়ে এসে মেসির এই ড্রিবলিংয়ের চূড়ান্ত পরিণতি টানেন জর্ডি আলবা।
শেষ পর্যন্ত বার্সার ৪-১ গোলের জয় ছাপিয়ে আলোচনায় তাই মেসির এই দুই ম্যাজিকাল মোমেন্ট, যা আরও একবার মনে করিয়ে দিল, শুধু গোল দেয়াই ফুটবলের সব কিছু নয়। গোল তো অনেকেই দেন, ইতিহাসের পাতায় কি তাঁদের সবার নাম মেসির মত উজ্জ্বলভাবে লেখা থাকবে? মেসি আজকের মেসি হয়েছেন শুধু গোলের পর গোল দিয়ে নয়, মেসি মেসি হয়ে উঠেছেন এরকম অজস্র মনোমুগ্ধকর, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকার মত মুহূর্তের জন্ম দিয়ে।
বহু বছর পর যখন নাতি-নাতনীদের গল্প শুনাবেন, তখন কিন্তু কে কয়টা গোল বেশি দিল, সেই হিসাব শুনাতে বসবেন না। বরং বোয়াটেংদের ভূপাতিত করে, নয়্যারের মত বিশ্বসেরা কিপারকে বোকা বানিয়ে কিভাবে মেসি সারা জীবন মনে রাখার মত কিছু মুহূর্তের সৃষ্টি করে গেছেন, সেই গল্পই শুনাবেন।
এখানেই মেসির মত কিংবদন্তিদের সার্থকতা। এই কিংবদন্তিরা শুধু গোল দিয়েই কিংবদন্তি হন না, এরা সময়ের উপর নিজের ছাপ রেখে যান। এনাদের কিংবদন্তি হতে ট্রফি লাগে না, এইসব মুহূর্তের জন্মদাতা হিসেবেই এরা কিংবদন্তি হন। বছর দশেক পরে ২০১৫-১৬ মৌসুমে কে কয়টা গোল দিয়েছে সেটা আপনি মনে রাখবেন না।
কিন্তু, ২০১৫ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে বায়ার্নের বিপক্ষে বোয়াটেংকে মাটিতে ফেলে দেয়া সেই গোল, ২০১৫ কোপা ডেল রে’তে অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে করা সেই অবিস্মরণীয় গোল, ২০০৭ এ গেটাফের বিপক্ষে ১৯ বছরের মেসির সেই আগমনীবার্তা প্রদানকারী গোল- এগুলো আপনি চাইলেও ভুলতে পারবেন? আপনি ফুটবলকে ভালোবেসে থাকলে,ব্যক্তিগত নৈপুণ্যকে সম্মান করে থাকলে এই গোলগুলো আপনি ভুলতে পারবেন না।
মেসিকে নিয়ে সবচেয়ে বড় সমালোচনা, তিনি জাতীয় দলের হয়ে বড় কোন ট্রফি জিততে পারেননি। আপনি মানুন কিংবা না মানুন, সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু লিওনেল মেসির কিংবদন্তি হওয়ার পথে ট্রফি না জেতা কোন বাধা হতে পারবে না।
লিওনেল মেসি কাল কিংবদন্তি ছিলেন, আজ কিংবদন্তি আছেন, যতদিন ফুটবল থাকবে ততদিনই কিংবদন্তি থাকবেন। আমাদের ট্রফি চাই না, আমাদের কেবল এই মেসিকে চাই, যেই মেসি আজীবন গল্প করার খোরাক জোগাবেন, যেই মেসি রিয়াল-বার্সা নির্বিশেষে সকলের মাঝে ফুটবলের আনন্দ বিলিয়ে যাবেন, যেই মেসি মানুষকে ফুটবলের প্রেমে পরতে বাধ্য করবেন। ট্রফি তো অনেকেই জেতেন, এভাবে মানুষের হৃদয় জেতেন কতজন!
(#collected 👈 প্রথমে এইটা দিছিলাম তবুও অনেকের পেট ভরে নি তাই ডিটেলসে বলি
পোস্টটা BDexpress থেকে নেয়া হইছে!
লিখছেন সঞ্জয় পার্থ নামের একজন!)
(আরো কিছু বাকি থাকলে কমেন্টে বলবেন এড করে দিব)
No comments:
Post a Comment