Monday, April 25, 2016

মজুর থেকে গোটা জার্মানির অধীশ্বর


অ্যাডলফ হিটলার, বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে নামটি অতিসুপরিচিত। নাৎসি নেতা ও জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার কারো কাছে চিরঞ্জীব বিশ্বনেতা আবার কারো কাছে অত্যন্ত কুখ্যাত এক খুনি! আজ হিটলারের জন্মদিন।


হিটলারের জন্ম ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল অস্ট্রিয়া ব্যাভেরিয়ার মাঝামাঝি ব্রনাউতে। ব্রনাউ হচ্ছে আধা গ্রাম আধা শহর। আর হিটলার ছিলেন তার বাবার তৃতীয় স্ত্রীর তৃতীয় সন্তান। বাবা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামান্য চাকরি করতেন। যা আয় করতেন তার তিন পতœী আর তাদের ছেলেমেয়েদের দুই বেলা খাবার সংকুলানই হতো না। আর তার ছেলেটিই কীনা একদিন হয়ে উঠল গোটা জার্মানের অধিশ্বর।

হিটলার ছেলেবেলার চরিত্রটি বদলাতে পারেননি মৃত্যু অবধি। ছেলেবেলা থেকেই হিটলার একগুঁয়ে, জেদি আর রগচটা। সামান্য ব্যাপারেই রেগে উঠতেন। অকারণে শিক্ষকদের সঙ্গে তর্ক করতেন। পড়াশোনাতে যে তার মেধা ছিল না এমন নয়। কিন্তু এগারো বছর বয়সে ঠিক করলেন আর পড়াশোনা নয়, ছবি আঁকবেন। একটা বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হলেন। কিন্তু কয়েক মাস পর অর্থের অভাবে স্কুল ছেড়ে দিলেন।

মা মারা গেলে ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়লেন হিটলার। ভিয়েনা চলে এলেন। প্রথমে মজুরের কাজ করতেন। কখনো মাল বইতেন। এরপর রং বিক্রি করতে আরম্ভ করলেন। এখানেই তার মনের মধ্যে প্রথম জেগে ওঠে ইহুদি বিদ্বেষ। তখন জার্মানির অধিকাংশ কলকারখানা, সংবাদপত্রের মালিক ছিল ইহুদিরা। দেশের অর্থনীতির অনেকখানিই তারা নিয়ন্ত্রণ করত। হিটলার কিছুতেই মানতে পারছিলেন না, জার্মান দেশে বসে ইহুদিরা জার্মানদের উপরে প্রভুত্ব করবে।

১৯১২ সালে তিনি ভিয়েনা ছেড়ে এলেন মিউনিখে। ১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিলেন। এই যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিলেন। যুদ্ধ শেষ হলো। দেশজুড়ে দেখা দিল হাহাকার আর বিশৃঙ্খলা। তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বিভিন্ন বিপ্লবী দল, রাজনৈতিক দল। এদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য হিটলারকে নিয়োগ করলেন কর্তৃপক্ষ।

সেই সময় প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল লেবার পার্টি। তিনি সেই পার্টির সদস্য হলেন। অল্পদিনেই পাকাপাকিভাবে পার্টিতে নিজের স্থান করে নিলেন হিটলার। এক বছরের মধ্যেই তিনি হলেন পার্টিপ্রধান। দলের নতুন নাম রাখা হলো ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স পার্টি। পরবর্তীকালে এই দলকেই বলা হতো নাৎসি পার্টি।

হিটলার চেয়েছিলেন মিউনিখে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব যেন না থাকে। এই নিয়ে পরিকল্পিত এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। তাকে এক বছরের জন্য ল্যান্ডসবার্গের পুরনো দুর্গে বন্দি করে রাখা হলো। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার উগ্র স্পষ্ট মতবাদ, বলিষ্ঠ বক্তব্য জার্মানদের আকৃষ্ট করল। দলে দলে যুবক তার দলের সদস্য হতে আরম্ভ করল। সমস্ত দেশে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন হিটলার।

১৯৩৩ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোট পেলেন। পার্লামেন্টের ৬৪৭টির মধ্যে তার দলের আসন ছিল ২৮৮। বুঝতে পারলেন ক্ষমতা অর্জন করতে গেলে অন্য পথ ধরে অগ্রসর হতে হবে। কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ায় হিটলার পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন। এবার ক্ষমতা দখলের জন্য শুরু হলো তার ঘৃণ্য রাজনৈতিক চক্রান্ত।

বিরোধীদের অনেকেই খুন হলেন। অনেকে মিথ্যা অভিযোগে জেলে গেল। বিরোধী দলের মধ্যে নিজের দলের লোক প্রবেশ করিয়ে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই বিরোধী পক্ষকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে হিটলার হয়ে উঠলেন শুধু নাৎসি দলের নয়, সমস্ত জার্মানির ভাগ্যবিধাতা। মোটামুটি এটাই হচ্ছে হিটলারের ‘হিটলার’ হওয়ার ইতিহাস।

এরপরের ইতিহাস আরও ভয়ঙ্কর। সামরিক বাহিনীকে নতুন নতুন সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেন হিটলার। নতুন আইন চালু করলেন হিটলার। তাতে দেশের নাগরিকদের দুটি ভাগে ভাগ করা হলো, জেন্টিল আর জু। জেন্টিল অর্থাৎ জার্মান, তারাই খাঁটি আর্য, জু হলো ইহুদিরা। তারা শুধুমাত্র জার্মান দেশের বসবাসকারী, এদেশের নাগরিক নয়। প্রয়োজনে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।

হিটলার রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে নিজেকে জার্মানির ফুয়েরার হিসেবে ঘোষণা করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে নিজেকে দেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। হিটলার তার সমস্ত ক্ষমতা নিয়োগ করেন দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত প্রদেশে বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটান।
একপর্যায়ে বিশ্বজয়ের আকাক্সক্ষায় উন্মত্ত  হন। সঙ্গে যোগ দেন ইতালির সর্বাধিনায়ক মুসোলিনি। একদিকে ইতালির ফ্যাসিবাদী শক্তি অন্যদিকে নাৎসি জার্মানি। প্রথমে আলবেনিয়া ও পরে ইথিওপিয়ার বেশ কিছু অংশ দখল করে নেয়।

হিটলার পোল্যান্ডের কাছে দাবি করেন ডানজিগ ও পোলিশ করিডর। যাতে এই অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে পারেন। পোল্যান্ডের সরকার তার এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। এই প্রত্যাখ্যান থেকেই সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। জার্মান বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করল। মূলত এই দিনটি থেকেই শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

মাত্র পনেরো দিনে জার্মান বাহিনী পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে পোল্যান্ড অধিকার করল। তারপর শুরু হলো জার্মান বাহিনীর অগ্রগমন। পোল্যান্ডের পর হিটলার দখল করলেন নরওয়ে ও ডেনমার্ক। নরওয়েতে বিরাট সংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য অবস্থান করছিল। তাদের অধিকাংশই নিহত হলো।

এবার হিটলার দৃষ্টি ফেরাল ফ্রান্সের দিকে। ফ্রান্স ইউরোপের সর্বপ্রধান শক্তি। ফ্রান্স নিজেদের সুরক্ষার জন্য জার্মান সীমান্তে দুর্ভেদ্য ব্যূহ সৃষ্টি করেছিল। বেলজিয়াম আক্রমণ করে সেই দেশের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের সীমান্ত প্রদেশে গিয়ে উপস্থিত হলো। তুমুল যুদ্ধের পর পরাজিত হলো ফরাসি বাহিনী।

ফরাসিদের এই বিপর্যয়ের সুবিধা নেওয়ার জন্য ইতালি নিজেকে জার্মানদের মিত্রপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে যুদ্ধে যোগ দিল। সমস্ত ইউরোপ-আফ্রিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ আগুন।

ফ্রান্স জয়ের পর জার্মানি যুগোস্লাভিয়া আর গ্রিস দেশ অধিকার করল। ইতিমধ্যে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি জার্মানির পক্ষে যোগ দিল। এর ফলে সমগ্র দক্ষিণ ইউরোপ জার্মানির নিয়ন্ত্রণে এসে গেল। একদিকে যখন জার্মান বাহিনী বীরদর্পে একের পর এক দেশ অধিকার করে এগিয়ে চলেছে, দেশের অভ্যন্তরে হিটলার শুরু করেছেন নারকীয় ইহুদি নিধনযজ্ঞ। পৃথিবীর ইতিহাসে এই নৃশংসতার কোনো তুলনা নেই।

হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যা করতে যে বিরাট পরিমাণ গুলি খরচ হতো তাতে জার্মান কর্তৃপক্ষ চিন্তিত হয়ে পড়ল। হিটলারের আদেশে তৈরি হলো গ্যাস চেম্বার। একটা বড় ঘর। চারদিকে বন্ধ। একসাথে দুইশত মানুষকে সেই ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ছাড়া হতো। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই বিষাক্ত গ্যাসে মারা পড়ত সবাই। তাদের মৃতদেহগুলো সীমান্ত অঞ্চলে বিরাট বিরাট গর্তে ছুড়ে ফেলে দেয়া হতো। তিন বছরে হিটলার প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিল।

ফ্রান্সের পতনের পর হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করল। রাশিয়া আক্রমণই ছিল হিটলারের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। জার্মানরা প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে চলে মস্কোর দিকে। রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করলেও শীত আসতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল জার্মানরা। তারা পিছু হটতে আরম্ভ করল। এই সুযোগে রুশ গেরিলা বাহিনী আঘাত হানতে থাকে। শীত শেষ হতেই জার্মানরা নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলে। রাশিয়ার দক্ষিণে ককেশাস তৈলক্ষেত্রসহ বহু অঞ্চল দখল করে দেয়। তারা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর প্রান্তে এসে পৌঁছায় কিন্তু রুশ বাহিনী মরণপণ সংগ্রাম করে জার্মানদের পরাজিত করে।

একদিকে যখন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ চলছে, জেনারেল রোমেল হিটলারের নির্দেশে আফ্রিকায় আরেকটি ফ্রন্ট খুললেন। একসাথে এতগুলো ফ্রন্ট না খোলার জন্য অনেকে হিটলারকে পরামর্শ দিলেও বিশ্বজয়ের স্বপ্নে হিটলার তখন এমনই বিভোর, কারোর কোনো উপদেশ গ্রহণ করলেন না।

ইউরোপজুড়ে যখন যুদ্ধ চলছে, এশিয়ার জাপান জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিল। তারা ৭ ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরের ওপর বোমা বর্ষণ করে বিধ্বস্ত করে ফেলল। এই ঘটনায় আমেরিকাও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।

প্রথম দিকে জার্মান বাহিনী সর্বত্র জয়লাভ করলেও মিত্রশক্তি যখন সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ আরম্ভ করল, হিটলারের বাহিনী পিছু হটতে আরম্ভ করল। এক বছরের মধ্যেই আফ্রিকা থেকে জার্মান বাহিনীকে বিতাড়িত করা হলো। ইতালিতে মুসোলিনিকে বন্দি করা হলো। ফ্যাসিবিরোধী জনগণ তাকে প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা করল।

হিটলার ক্রমশই সঙ্গীসাথীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকেন। সকলের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। বেশির ভাগ সময়ই বাঙ্কারে থাকতেন। সেখান থেকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। এই সময় তার একমাত্র সঙ্গী ছিল প্রেমিকা ইভা ব্রাউন।

যতই চারদিক থেকে পরাজয়ের সংবাদ আসতে থাকে হিটলার উন্মত্তের মতো হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল হিটলারের শেষ ভরসা তার স্টেইনের সৈন্যবাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তার অধিকাংশ সঙ্গীই তাকে পরিত্যাগ করে মিত্রপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায়। হিটলার বুঝতে পারেন তার সব স্বপ্ন চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেছে। বার্লিনের প্রান্তে রুশ বাহিনীর কামানের গর্জন শোনা যাচ্ছে। হিটলার তার বারো বছরের সঙ্গিনী ইভাকে বার্লিন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইভা তাকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। দুজনে সেই দিনেই বিয়ে করেন।

বিয়ের পর হিটলার উপস্থিত সঙ্গীদের সাথে একসঙ্গে শ্যাম্পেন পান করলেন। তারপর দুটি চিঠি লিখলেন। একটি চিঠিতে সবকিছুর জন্য ইহুদিদের অভিযুক্ত করলেন। অন্য চিঠিতে নিজের সব সম্পত্তি পার্টিকে দান করে গেলেন।

৩০ এপ্রিল ১৯৪৫। হিটলার বুঝতে পারেন আর অপেক্ষা করা উচিত নয়। যে কোনো মুহূর্তে তিনি বন্দি হতে পারেন। তিনি তার ড্রাইভার ও আরো একজনকে বললেন, মৃত্যুর পর যেন তাদের এমনভাবে পোড়ানো হয়, দেহের কোনো অংশ যেন অবশিষ্ট না থাকে।

বিকেল সাড়ে তিনটার সময় তিনি নিজের ঘর থেকে বের হয়ে তার পার্শ্বচরদের সঙ্গে করমর্দন করে নিজের ঘরে ঢুকলেন। তারপরই শব্দ শোনা গেল। হিটলার নিজের মুখের মধ্যে গুলি করে আত্মহত্যা করলেন। আর ইভা আগেই বিষ খেয়েছেন। দুজন সৈন্য তাদের কম্বল দিয়ে মুড়ে বাগানে নিয়ে এল। চারদিক থেকে কামানের গোলা এসে পড়ছে। সেই অবস্থাতেই মৃতদেহের ওপর পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো।

No comments:

Post a Comment