জ্ঞানীজনেরা বলেন, অধ্যবসায়কে সুহৃদ, অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞ মন্ত্রণাদাতা, আত্মবিশ্বাস এবং সীমাহীন স্বপ্নকে পথ চলার সঙ্গী করতে পারলে সাফল্য সুনিশ্চিত। এর সাথে পরিশ্রমটাকেও যোগ করুন। কেননা যেখানে পরিশ্রম নেই, সেখানে সাফল্যও নেই। কিন্তু যথেষ্ট পরিশ্রম করার পরেও সাফল্য মুঠোয় ধরা না দিলে বুঝতে হবে সাফল্য লাভের প্রাথমিক পরিকল্পনাতেই গলদ রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকে হয়তো ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ এ কথা ভেবে সান্ত্বনা খুঁজবেন।
তারপর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পুনরায় নতুন পথে হাঁটতে শুরু করবেন। কিন্তু ভুল পথে হাঁটলে প্রতিবারই আপনার পণ্ডশ্রম হবে। অধরাই রয়ে যাবে সাফল্য। এখানে আপনাকে কিছুটা কৌশলী হতেই হবে। তারও আগে জানতে হবে সাফল্য লাভের কৌশল।
অটুট লক্ষ্য
চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিভ্রান্ত এক পথিক একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ভাই, এ রাস্তা কোথায় গেছে? শুনে লোকটি উল্টো তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাবেন? পথিক কিছুক্ষণ ভেবে বলল, আমি জানি না।
এবার লোকটি মৃদু হেসে বলল, তাহলে চিন্তার কিছু নেই। আপনি যে রাস্তা ধরেই যান না কেন পার্থক্য খুব বেশি হবে না।
লক্ষ্য ছাড়া জীবন অনিশ্চিত। যে কোনো কাজে সফল হতে প্রথমেই লক্ষ্য স্থির করে নিন। কেননা লক্ষ্য হল সাফল্যের পথের প্রথম দরজা। এ দরজা দিয়ে সাফল্যের স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার অর্থই হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি সিঁড়ি আপনি পার হলেন।
দৃঢ় আত্মবিশ্বাস
দার্শনিক ইমারসন আত্মবিশ্বাসকে সাফল্যের গূঢ়তত্ত্ব মেনেছেন। সাফল্য আসে আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে। যে ভাবে ‘আমি পারব না’, সে করার আগেই হেরে যায়। কারণ চেষ্টা করার জন্য যতটুকু আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন ততটুকু আত্মবিশ্বাস তার থাকে না। অন্যদিকে যে ভাবে ‘আমি পারব’, সে চেষ্টা করে। তার আত্মবিশ্বাস তাকে মানসিক শক্তি জোগায়। এখন প্রশ্ন হল, আত্মবিশ্বাস অর্জিত হবে কীভাবে? আত্মবিশ্বাস জন্মে গভীর চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে, আর চিন্তার বিকাশ ঘটে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার মাধ্যমে। সুতরাং সবকিছু বিবেচনা দিয়ে বিশ্লেষণ করুন। একবার নয় বার বার বলুন ‘আমি পারব’, ‘আমি করব’।
স্বপ্ন দেখুন
আপনাকে স্বপ্নবাজ হতে বলছি না। আপনার লক্ষ্যটাকে কল্পনার চোখে দেখুন। ‘জ্ঞানের চেয়ে কল্পনার শক্তি ঢের বেশি’-এ কথা মণীষী আইনস্টাইন স্বয়ং বলে গেছেন। অতএব, আপনি যা হতে চান সে ছবি স্পষ্টভাবে মনের ঘরে এঁকে ফেলুন। এবার দিন কি রাতে সাঝ প্রভাতে যখনই সময় পাবেন আপনার স্বপ্নের কথা ভাবুন। সাধারণত নিজের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ নেতিবাচক কিছু ভাবে না। ফলে স্বপ্ন নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা আপনাকে সাহস যোগোবে। সেই সাহস বুকে ধারণ করে এগিয়ে গেলেই আপনি আপনার স্বপ্নলোকের রাজপ্রাসাদে পৌঁছে যাবেন। তাছাড়া এটা তো ঠিক যে সফলতা কখনও অন্ধ হয় না। তাহলে ভবিষ্যতের ছবি কল্পনায় দেখতে বাঁধা কোথায়?
পোক্ত পরিকল্পনা
সকল বিষয়ে সাফল্য নির্ভর করে পূর্ব প্রস্তুতির উপর। এ রকম ‘প্রস্তুতি ছাড়া ব্যর্থতা অবশ্যম্ভবী’- সাফল্য বিষয়ে দার্শনিক কনফুসিয়াসের এই বাণীর পরের বাক্যটি হল, ভালো প্রস্তুতি নির্ভর করে সঠিক পরিকল্পনার উপর। আর এ কারণেই সুচিন্তিত পরিকল্পনাকে সাফল্যের নকশা বলা হয়। আপনি আপনার অবস্থান এবং স্বপ্নের মধ্যবর্তী দূরত্বটুকু প্রথমে মেপে বের করুন। মাঝখানে যে বাধাগুলো আছে সেগুলোকে চিহ্নিত করুন। বাধাগুলো চিহ্নিত করতে পারা মানে সাফল্যের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। এবার বাধাগুলো কীভাবে দূর করবেন সে বিষয়ে পরিকল্পনা করুন। এ পরিকল্পনায় কোনো প্রকার খুঁত থাকা চলবে না।
কর্মে তৎপর
শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না। হতে হবে কর্মতৎপর। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে আপনার সমস্ত পরিকল্পনা থেকে ‘পরি’ উড়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত শুধু কল্পনাটুকুই রয়ে যাবে। যদিও কর্মতৎপরতার সাথে দক্ষতার সম্পর্ক এবং পার্থক্য দুটোই রয়েছে। মানুষ কর্মে তৎপর হয়েই একসময় ধীরে ধীরে দক্ষতা অর্জন করে। অন্যদিকে পার্থক্য হল কর্মতৎপরতা দিয়ে কাজটি দ্রুত করা বোঝালেও দক্ষতা দিয়ে কাজটি নিপুণভাবে করা বোঝায়। এ দুটো বিষয়ে সামঞ্জস্য থাকলে সাফল্যের পেছনে আপনাকে ছুটতে হবে না। সাফল্য নিজে আপনার মুঠোয় ধরা দেবে।
সময় সাধন
সময় গেলে সাধন হবে না। সাফল্যের জন্য আপনি তো সাধনাই করছেন সুতরাং সময় থাকতেই সময়ের কাজ করতে শুরু করুন। আপনার পরিকল্পনায় সাফল্যের দরজায় গিয়ে পৌঁছুতে যে সময় নির্ধারণ করেছিলেন সে সময়টুকু বছর, মাস এমনকি সপ্তাহে ভাগ করে নিন। সপ্তাহের কাজ এবার সাত দিনে ভাগ করুন। অর্থাৎ সাফল্য অর্জনে দিনের কাজ দিনেই শেষ করুন। আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখার অর্থ হল ব্যর্থতার দিকে হেঁটে যাওয়া।
স্পপ্ন ছোঁয়ার সাহস
সাহসহীন ব্যক্তির পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়। কেননা সাফল্যের চূড়ায় ওঠার পথে আপনাকে একাধিক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। সাহস নিয়ে ধৈর্যের সাথে বাধার মোকাবেলা করতে হবে। এছাড়া সাহসীরাই দ্রুত ইতিবাচক চিন্তা করতে পারে। ইতিবাচক মনোভাব সাফল্যের চাবিকাঠি। যদিও এটি হঠাৎ করে অর্জন করার বিষয় নয়। সাফল্য স্পর্শ করতে আপনি যে পরিকল্পনা করেছেন সেই পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন আপনাকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। এই অনুপ্রেরণা আপনাকে এক সময় সাহসী করে তুলবে।
যোগাযোগ
‘সাফল্যের গোপণ কথা হচ্ছে, অন্যের মত বুঝতে পারার ক্ষমতা এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে মিলিয়ে ঘটনার বিচার করা’- মণীষী ডেল কার্নেগীর এ কথা থেকেই সাফল্যের জন্য যোগাযোগ দক্ষতা যে কতটুকু গুরুত্ব বহন করে বোঝা যায়। এজন্য বক্তা নয়, প্রথমেই ভালো শ্রোতা হতে হবে। এছাড়াও অন্যের কাজের প্রশংসা, সামাজিক হওয়া, মানুষের সাথে মিশতে পারা, মানুষকে মূল্যায়ণ করা ইত্যাদি চর্চার মাধ্যমে যোগাযোগ দক্ষতা বাড়িয়ে তোলা যায়।
সবুরে মেওয়া
সাফল্যের নাকি সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। সুতরাং ধৈর্য অনিবার্য। এ জন্য প্রয়োজন মানসিক শক্তি। বিজ্ঞানী নিউটনের কথাই ধরুন, একবার গবেষণার মূল্যবাণ কাগজপত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল তার। তিনি ধৈর্য ধরে পরবর্তীতে নতুন করে পুনরায় গবেষণা শুরু করেছিলেন। টমাস আলভা এডিসন অসংখ্যবার পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। মানুষের মনে যে সুপ্ত শক্তি রয়েছে, তার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশের জন্য মানসিক প্রশান্তির বিকল্প নেই।
নিজেকে জানা
সাফল্য সাময়িক। তাই সফলতাই শেষ কথা নয়। সাহিত্যিক বিমল মিত্রের কথা ধার করে বলা যায়, সাফল্যের সার্থকতা মানুষকে শুধু আরও বড় সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সাফল্য মানুষকে সুখী করে না আরও দুর্গম পথের যাত্রী করে। বৃহত্তর সাফল্যের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রলুব্ধ করে। আর এজন্যই প্রয়োজন নিজেকে ভালো করে জানা। কেননা সাফল্যের এক দরজার পরেই থাকে আরেক দরজা। সেই দরজা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে।
No comments:
Post a Comment